মো. খালেদ সাইফুল্লাহ:
ছাত্র জীবনে আমাদের একাডেমিক শিক্ষা নিয়েই বেশ ব্যস্ত থাকতে হয়। ক্লাস,পরীক্ষা আর অ্যাসাইনমেন্টের চাপে কখনও কখনও মস্তিষ্ক দিশেহারা হয়ে যায়। তখন কংক্রিটের দেয়ালের বন্দিদশা থেকে মন চায় বাহিরের উন্মুক্ত দুনিয়ায় নিশ্বাস নিয়ে জীবনের স্বাদ আস্বাদন করতে। পরীক্ষার চাপ আর ব্যস্ততার পরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে তার শীতলতায় মনকে ফুরফুরে করতে আমরা ডিপার্টমেন্টের ছয় বন্ধু হঠাৎ করেই পরিকল্পনা করি একবেলা শর্ট ট্যুরের।
আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের অবস্থান সীতাকুণ্ডের কুমিরায়। পরীক্ষা শেষে ভার্সিটির বাসে চেপে বসি আমরা। যেতে চাই সাগর, পাহাড় আর ঝর্ণার রাজ্য সীতাকুণ্ড। কোনটা রেখে কোনটায় যাব তা নিয়ে বন্ধুদের মাঝে বিতর্ক জমে ওঠে। বাসে উঠেও দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছি গন্তব্য নিয়ে। দুই দুইবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে অবশেষে গন্তব্য নির্ধারণ হয়েছে সীতাকুণ্ড বোটানিক্যাল গার্ডেন ইর্কো পার্ক। যা চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে ৮০০ হেক্টর জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য এবং পর্যটকদের বিনোদনের জন্য বন বিভাগের প্রচেষ্টায় গড়ে তোলা পার্কটিতে রয়েছে বিরল প্রজাতির গাছপালা, হাজার রকমের নজরকাড়া ফুলের গাছ, কৃত্রিম লেক ও নানা প্রজাতির জীববৈচিত্র্য। এছাড়া রয়েছে সুপ্তধারা ও সহস্রধারা ঝর্ণাসহ ঝিরিপথের ছোট-বড় বেশ কয়েকটি ঝর্ণা, বিশ্রামের ছাউনি।
সীতাকুণ্ড পৌঁছাতে পৌঁছাতে ভরদুপুর। সিদ্ধান্ত হলো দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা প্রবেশ করবো পার্কে। সীতাকুণ্ডে বিখ্যাত খাবার হলো ভাবির হোটেলের চুই ঝাল। দ্বিতীয় কোন চিন্তা না করেই পেট পুজো শেষে এবার সীতাকুণ্ড ইকো পার্কের পথে আগালাম। এটি চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং রেলপথের পূর্ব পাশে অবস্থিত। চট্টগ্রাম শহর হতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ধরে এগোলে কুমিরা বাড়বকুণ্ড অতিক্রম করতে করতে পূর্ব পাশে চোখে পড়বে সুউচ্চ পাহাড়ের ওপর চন্দ্রনাথ মন্দির। যার পাদদেশে অবস্থিত বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক। সীতাকুণ্ড উপজেলা সদর থেকে দুই কিলোমিটার দক্ষিণে ফকিরহাট বাজার সংলগ্ন মহাসড়কের পূর্ব পাশে রঙিন ফটকসহ সাইনবোর্ড ইকোপার্কের দিক নির্দেশনা দেয়া আছে।
মহাসড়কের পাশে ইকোপার্কের গেটে নেমে সিএনজি নিয়ে আমি, বন্ধু ইশরাক, আইনুল, সাজ্জাদ, রাশেদ, মুজাহিদ ও সাদমান সিএনজিতে উঠে পড়ি। প্রধান ফটকে পৌঁছাতে ৫০ টাকা করে ভাড়া। ভেতরে প্রবেশের জন্য ৩০ টাকায় টিকিট সংগ্রহ করে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করি। ভেতরে পাহাড়ে উঠার জন্য সুপ্রশস্ত রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। সিএনজিও চলাচল করে। রিজার্ভ সিএনজি নিতে হলে আসা যাওয়া ৫০০-৬০০ টাকা। পথ দীর্ঘ নয়; পায়ে হেঁটে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। তাই অ্যাডভেঞ্চার প্রিয়দের জন্য প্রকৃতির মাঝে পাহাড়ি রাস্তায় হেঁটে ওঠাই উপভোগ্য।
বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের প্রধান ফটকের ভেতরে ডান পাশে রয়েছে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্কের প্রধান নার্সারি এবং তার অফিস। এই নার্সারিতেই আছে দেশ-বিদেশের নানা প্রচলিত ও বিলুপ্ত প্রজাতির ফুল, ফল ও ঔষধি গাছ যেমন– অর্জুন, তেলসুর, চাপালিস, চুন্দুল, কড়ই, জারুল, তুন। সামনে এগিয়ে উঁচু-নিচু নির্জন পাহাড়, পাখ-পাখালির কলরব, প্রাকৃতিক ঝর্ণা, চিরসবুজ বৃক্ষরাজিসমৃদ্ধ ইকোপার্ক খুবই মনোমুগ্ধকর। সবুজের বুক চিড়ে সূর্যের চাহনি যেন এক নৈসর্গিক পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।
চন্দ্রনাথ রিজার্ভ ফরেস্ট এলাকায় অনেক ছোট-বড় ঝর্ণা আছে। বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক এলাকার মধ্যে দুটি ঝর্ণা রয়েছে। ঝর্ণা দুটি সহস্রধারা ও সুপ্তধারা নামে পরিচিত। সহস্রধারা থেকে অবিরত পানি ঝরে। কিন্তু সুপ্তধারা থেকে শীতকালে খুব কম পানি ঝরে। আমাদের এ যাত্রায় গন্তব্য সুপ্তধারা।
হাঁটার সময় পাহাড়ি ঘন জঙ্গলে ছোট ছোট টিলার মতো জঙ্গল উঠে গেছে রাস্তা থেকে আরও ওপরের দিকে। কখনওবা নেমে গেছে একদম খাদের মতো নিচের দিকে। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দের ঝিম ধরানো ভাব আর নিস্তব্ধ এমন পরিবেশ, সবুজের বুক চিরে ক্লান্ত হয়ে হেঁটে চলার নতুন অভিজ্ঞতা হলো। পথিমধ্যে থামছিলাম বিভিন্ন ভিউ পয়েন্ট থেকে চারিদিকের চোখ ধাঁধাঁনো সবুজের সমারোহ দেখার জন্য। বন্ধু ইশরাক মোবাইল ফটোগ্রাফিতে বেশ ভালো, সাথে সাজ্জাদ ভিডিও কনটেন্টের জন্য ক্লিপ নিচ্ছিল। টানা একঘণ্টা কিংবা তার খানিকটা বেশি হাঁটার পর সুপ্তধারা ঝর্ণার চেকপয়েন্টে এসে দাঁড়ালাম আমরা। প্রচণ্ড কষ্টে ঘাম ঝরছে শরীর থেকে। তৃষ্ণায় এক লিটার পানির বোতল কিনে গড়গড় করে গিলে ফেললাম।
এবার পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নামার পালা। চেক পয়েন্ট থেকে ডান দিকে নিচে নামার জন্য সিঁড়ি রয়েছে। খানিক বিশ্রাম নিয়েই নেমে পড়লাম আসল উদ্দেশ্যে। সৌন্দর্য উপভোগ করতে এতক্ষণ পাহাড়ে উঠেছি এবার আমাদের নামতে হবে সিঁড়ি বেয়ে। পাহাড়ের গাঁয়ে খোদাই করা প্রায় সাড়ে চারশ’ সিঁড়ি অতিক্রম করতে হবে। শুরু হলো আমাদের যাত্রা। যতই নিচে নামছি ততই ঝর্ণার গর্জন শুনতে পাচ্ছিলাম আমরা। যখন পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে গেছি, নিচে তাকিয়েই ঝিরিপথ দেখা যাচ্ছে। বন্ধু রাশেদ, মুজাহিদ জুতা খুলে আগেই নেমে পড়েছে। জুতা হাতে নিয়ে হাঁটু পানি পার হয়ে ঝিরিপথ ধরে সোজা হাঁটা শুরু ঝর্ণা দেখার উদ্দেশ্যে। কমপক্ষে ২০/২৫ মিনিট হাঁটতে হয়।
দীর্ঘ দেড় ঘণ্টা পরিশ্রম করে, পায়ে হেঁটে পৌঁছাতে হয়েছে সুপ্তধারা ঝর্ণায়। ঝর্ণার সৌন্দর্য দেখে হেঁটে আসতে পায়ের ব্যথা, মাংসপেশির যন্ত্রণা, পরস্পরের দোষারোপ সব যেন উবে গেছে। এখন শুধু উল্লাস আর ফটোসেশন। ঝর্ণার সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। এখানে পাশাপাশি দুইটি ধারা। পাশদিয়ে খানিক উপরে একটা পাহাড়ের মাঝে একটা খাঁজকাটা জায়গা আছে। যদিও অনেক বেশি ঝুঁকি, তবুও ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখতে পারিনি আমি। ভয় নিয়েই সেখানে উঠে বসার পর মনে হচ্ছিল, শুধু ঝর্ণা ঝরে পড়ছে অঝোর ধারায়। আর আমি বসে ছিলাম ভিন্ন এক গ্রহে। এই চমৎকার মুহূর্তটি ক্যামেরা বন্দী করে বন্ধু ইশরাক।
এবার বিপত্তি বাঁধে নামতে। ভয়ে ভয়ে অনেক কষ্টে নামতে হয়েছে। সবাই ঘণ্টাখানেক বরফশীতল জলে ক্লান্তি ধুয়ে নিয়ে উঠে পড়লাম। শরীরের ভেজা পোশাক পরিবর্তন করে এবার ফেরার পালা। এখন ভয় আবারও সেই সারে চারশো সিঁড়ি বেয়ে পাহাড়ের উপরে উঠার।
গল্প করতে করতে ঝিরিপথ পাড়ি দিতে পাহাড়ের পাদদেশে ফিরে একত্রে সিঁড়ি বেয়ে রওনা হয়েছি। শরীর ভীষণ ক্লান্ত। তাই ধীরগতিতে বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে উঠতে হচ্ছে। সহস্রধারা ঝর্ণার চেকপয়েন্টে এসে উঠে আর নড়ার শক্তি ছিল না। সেখানে বিশ্রামের জন্য তৈরি ছাউনিতে আমরা ১৫/২০ মিনিট বিশ্রাম নেই। এই ফাঁকে পরবর্তী ট্যুরের প্ল্যান সাজাই।
পানি আর শুকনো খাবার খেয়ে এবার পাকা রাস্তা ধরে ইকো পার্কের নিচের দিকে নামা শুরু। সুর্য পশ্চিম আকাশের দিকে হেলে পড়েছে। পড়ন্ত বিকেলে পায়ে হেঁটে আমরা প্রধান ফটকে পৌঁছে ইকোপার্ক থেকে বের হই। সিএনজি নিয়ে মহাসড়কে চলে এসে বাসযোগে নিজ নিজ গন্তব্য পৌঁছাই।
সাবধানতার বিষয় হলো ঝর্ণায় যাওয়ার পথে দীর্ঘ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামা লাগে। তাই ভারি ব্যাগ নিয়ে নামা যাবে না। কারণ ব্যাগ নিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠতে অনেক কষ্ট হয়। সিঁড়িগুলো বৃষ্টিতে পিচ্ছিল হয়ে যায়। তাই সাবধানে সময় নিয়ে ধীরে ধীরে নামতে হবে। কারও সাথে প্রতিযোগিতা করতে যাবেন না। জীবনের মূল্য বেশি। ভাল গ্রিপওয়ালা বেল্ট স্যান্ডেল পড়ে নিলে সুবিধা হয়। অবশ্যই খুব সহজে পরিধান করা যায় এমন কাপড় নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।
(যেহেতু এটি পাঠকের লেখা, তাই তথ্যসম্পর্কিত বা অন্য দায়দায়িত্ব যমুনা টেলিভিশন অনলাইন কর্তৃপক্ষের নয়)
Leave a reply