‘লেখকের দায়’ বলে কিছু নেই: শেখ রানা

|

সবুজ তার এতোই প্রিয় যে, তার নাম হয়ে গিয়েছিল ‘বৃক্ষ রানা’। এক জীবনে যিনি শুধু গীতিকবিই হতে চেয়েছেন, রেসের ঘোড়া হতে চাননি। একাডেমিক পড়াশুনা ছেড়ে-টেড়ে তাই শব্দের তালাশে সবুজের বুকে ছুটে বেড়িয়েছেন। যিনি বিশ্বাস করেন, শব্দ নাজেল হয়; তাকে টুপ করে লুফে নিতে হয়। একারণে তার লিরিকের শরীরজুড়ে একটা মসৃণ ম্যাজিক থাকে, যা শ্রোতাকে অবাধে অবশ করে।

যিনি নিজে হেরে সবাইকে জিতিয়ে দিতে চান, তার নাম শেখ রানা। বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার গীতিকবিতার বই ‘মফস্বলের দুপুর’। দীর্ঘ আলাপে উঠে আসে তার লেখালেখি বা জীবন দর্শন প্রসঙ্গও। লেখকের সঙ্গে কথা বলেছেন আল মাহফুজ।

আল মাহফুজ: কেন গীতিকবিই হলেন? অন্য কিছুও তো হওয়া যেতো..

শেখ রানা: আমি কিছুই হতে চাইনি আসলে। সবাইকে কেন কিছু না কিছু হতেই হবে, এই প্রশ্ন বহুদিন আমাকে তাড়িত করেছে। মগ্ন হয়ে গান শুনতাম। গানের সুরের চেয়েও কথার দিকে ঝুঁকে থাকতাম। এই ভালোবাসাটাই হয়তো গীতিকার হবার কারণ। আর একটা কারণ হয়তো নব্বইয়ের সময়টা আর আমার হাইকোর্ট কলোনির সবুজে ঘেরা চারপাশ।

আল মাহফুজ: আপনার লেখায় ঘুরেফিরে হাইকোর্ট, পাকুড় গাছ, কলোনি ইত্যাদি প্রসঙ্গ বারবার উঠে আসে। দীর্ঘ লেখালেখির জীবনে এসবের প্রভাব কতোটুকু?

শেখ রানা: প্রবলভাবে জড়িয়ে আছে। হাইকোর্ট কলোনির সবুজ গায়ে মাখতে মাখতেই বড় হয়েছি আমি। সবুজ, বৃষ্টি.. সেই টিনের বাসায় দুপুরবেলা বসে একা একা বই পড়া বা ভাবা, সবই আসলে আমার লেখার অনুসঙ্গ।

আল মাহফুজ: আপনি বললেন, ‘সবাইকে কেন কিছু না কিছু হতেই হবে? এই প্রশ্ন বহুদিন ঘুরপাক খেয়েছে।’ আসলেই তো। নীরবতা কি অনেক কথা বলতে পারে না? অন্ধকারের গহীনে কি আলোর আভাস অসম্ভব? অথবা কেন প্রথা মেনে আলোর দেখাই পেতে হবে? আঁধারেও তো কারও হারানোর স্বাধীনতা বা ইচ্ছে থাকতে পারে।

শেখ রানা: বা ধরো, কারও হারানোরও অভিপ্রায় নেই। আলোকেও আলিঙ্গন করতে চায় না। সে হয়তো অল্পতে খুশি। একটা নিস্তরঙ্গ জীবন যাপন করতে চায়। রেসের ঘোড়া বা গাধা হবার কোনো ইচ্ছে তার নেই। সে সবাইকে জিতিয়ে দিতে চায়। হেরে যাওয়াতে তার আক্ষেপ নেই এতোটুকু!

আল মাহফুজ: কি দারুণ বললেন! তবে সবাইকে হয়তো জিতিয়ে দিতে সবসময় মন সায় দেয় না। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন যখন হয়, আপনি কী চেয়েছিলেন? স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন কেমন প্রভাব ফেলেছিল? তখন আপনি কোন ক্লাসে পড়তেন?

শেখ রানা: নব্বইয়ে আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। এই অভিজ্ঞতা আমি কখনও ভুলবো না। হাইকোর্টের ঠিক পাশেই তো প্রেসক্লাব। কতোদিন বিকেল গেছে, টিয়ারশেলের ঝাঁঝে আমরা খেলা বাদ দিয়ে চোখ মুছছি অথবা পুলিশের তাড়া খেয়ে তখনকার রাজপথের নেতা-নেত্রীরা হাইকোর্টে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। যে রাতে এরশাদ পদত্যাগের ঘোষনা দিলো, পরদিন সারাদিন আমি প্রেসক্লাবের আশেপাশে। আরও ভালো করে বললে সার্ক ফোয়ারার ঠিক এই পাশে, যেখানে ঈদগাহ মাঠের গেট। দাঁড়িয়ে মিছিল দেখেছি সারাদিন আর গলা মিলিয়েছি। মানুষের আনন্দমুখ দেখার স্মৃতি আনন্দের। ডাইরিতে লেখতাম খুব। এরশাদ পতনের পর সম্ভবত প্রথম আমি কিছু ছন্দ মিলিয়ে স্যাটায়ারধর্মী লেখা লিখেছিলাম। সেটাই মূলত আমার লেখালেখির শুরু।

আল মাহফুজ: তখন আপনার লেখালেখির শুরু। কিন্তু আপনি রাজশাহীতে বাংলাদেশ ইনিস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (বিআইটি) পড়েছেন। সেখানেই প্রথমবারের মতো নিজেকে গীতিকবি হিসেবে আবিষ্কার করলেন। এটা কীভাবে হলো? কারণ, সক্রেটিস বলেছিলেন– ‘নো দাইসেল্ফ’ অর্থাৎ নিজেকে জানো। গোটা জীবন অতিবাহনের পরও তো অজস্র মানুষ নিজেকে জানতে পারে না। ‘আমাকে লিরিসিস্টই হতে হবে’– এই পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করার অনুসন্ধানটা কেমন ছিল? কীভাবে অর্জন করলেন তা?

শেখ রানা: বলা কঠিন, মাহফুজ। ঠিক কীভাবে নিজেকে এই জায়গায় আবিষ্কার করলাম। এটুকু বলতে পারি, বিআইটিতে পড়াকালীন আমি লেখা নিয়ে সিরিয়াস হলাম। সিরিয়াসলি চিন্তা-ভাবনা শুরু করলাম। শব্দ খুঁজে পেতে শুরু করলাম। একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যাওয়া, শব্দ খোঁজা; এসবের মধ্যে দিন শুরু করলাম। একটা অতর্কিতে বোহেমিয়ানিজম আমাকে একদম গ্রাস করে নিলো। এটাও সত্যি, প্রকৌশলবিদ্যা আমাকে সেভাবে আকর্ষণ করছিলো না। সব মিলিয়ে আমার মনে হলো, এই গীতিকার জীবনই আমার ভবিতব্য। আমার আর উপায়ই নেই, অন্য কোথাও যাবার। অন্য কিছু ভাবার। আমি লেখাকেই ভালোবাসলাম। লিরিক আসতে লাগলো আমার হাত ধরে একের পর এক।

আল মাহফুজ: বোহেমিয়ানিজম গ্রাস করার পর শেখ রানা একাডেমিক পড়া-টড়া ছেড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, শব্দের তালাশ করছে। এটা কল্পনা করতে খুব রোম্যান্টিক হলেও সমাজ বাস্তবতায় বেশ কঠিন। এই পথে নিশ্চয়ই অনেক বাধা এসেছিল তখন। পরিবার, স্বজন, সমাজ ইত্যাদি থেকে। সেগুলো কেমন ছিল (দুয়েকটা গল্প যদি বলা যায়)? সেই বাধার প্রাচির টপকালেনই বা কেমন করে?

শেখ রানা: নাহ, কঠিন ছিল সময়টা আসলেই। জীবনকে কখনোই এতোটা ছেড়ে দিতে হয় না, যে তার ফিরে আসার পথ বিপদসঙ্কুল হয়ে যায়। বোহেমিয়ান সময় কাটিয়েছি আমি। একেবারে শঙ্কাহীন। চারপাশ রীতিমতো অস্বীকার করে। এখন ভাবলে মনে হয়, একটু লাগাম ধরা উচিত ছিল। নিজেকে আর একটু আগে চিনলে, নিজের সাথে কথোপকথন একটু আগে শুরু করতে পারলে ভালো হতো। আব্বা-আম্মা স্বভাবতই কষ্ট পেয়েছিলেন প্রকৌশলবিদ্যা ছেড়ে গীতিকার হবার সিদ্ধান্তে। সেই কষ্ট পাওয়া খুব সত্য। কিন্তু আমাকে যে বাধায় রেখেছিলেন, তাও নয়। অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও আমার প্যাশনটাকে মেনে নিয়েছিলেন। আব্বা আম্মা বা পরিবারের সবার জন্য ধাক্কা বেশি ছিল। কারণ, ভালো স্কুল-কলেজে পড়েছি। ছাত্র হিসেবেও ভালো রেজাল্ট করতাম। শুরু থেকেই অমনোযোগী থাকলে এক কথা ছিল! কিন্তু সত্য এও, সেই বোহেমিয়ানিজম, শব্দ তালাশের দিন, মাথার ভেতর আর কিছু নেই শুধু লিরিক লেখা, গান হওয়া নিজের– আমাকে একেবারেই গ্রাস করে নিয়েছিল।

আল মাহফুজ: এই শব্দ তালাশ আপনাকে গ্রাস করে নেয়ার ফলেই হয়তো বাংলা সংগীতে শেখ রানা আলাদা একটি জায়গা করে নিয়েছে। আপনার লিরিকে কণ্ঠ দিয়েছেন আজম খান। আপনার লেখা ‘গাছ’, ’সবুজ যখন’, ‘ফিরে পেতে চাই’ গেয়েছেন বাংলা গানের আরেক বিস্ময়কর প্রতিভা সঞ্জীব চৌধুরী। তার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?

শেখ রানা: সঞ্জীবদার সাথে কাজ করা আমার জীবনের অনেক বড় একটা অভিজ্ঞতা। আমার কাছে মনে হয় প্রাপ্তি। দলছুটের ‘আহ’ অ্যালবাম শুনে আমি সঞ্জীব-বাপ্পার সাথে গীতিকার হিসেবে কাজ করতে চেয়েছিলাম। আর কিছুই চাইনি। সঞ্জীবদার সাথে আমার অনেক স্মৃতি। দলছুটের যখন ‘হৃদয়পুর’-এর কাজ চলছিল, তখন সঞ্জীবদার সাথে আমার প্রথম দেখা। ‘গাছ’ গানটা প্রথম যখন শুনি, আমার গীতিকার জীবনের একটা স্মরণীয় মুহূর্ত সেটা। ‘সবুজ যখন’, তারপর ‘ফিরে পেতে চাই’, সঞ্জীব-বাপ্পা যুগলবন্দী। গান হবার পর এই লিরিকগুলো যে আমার লেখা, তখনও হৃদয়ঙ্গম করতে পারিনি। এখনও মাঝেমাঝে অবিশ্বাস্য লাগে যে, সঞ্জীবদা আমার লিরিকে গান গেয়েছেন!

সবুজের বুকে সস্ত্রীক শেখ রানা

সঞ্জীবদা আমাকে ‘বৃক্ষ রানা’ ডাকতেন মাঝেমাঝে, মজা করে। ‘গাছ’ গানটা গাইবার পরে। আমুদে মানুষ ছিলেন, প্রজ্ঞাবান আর জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। বাংলা গানের বিষয়ভিত্তিক ধারা নব্বই থেকেই শুরু হয়েছিল, তাতে জোর হাওয়া দিয়েছিল নব্বইয়ের শেষ অংশে এসে সঞ্জীবদার লিরিক। আমি একটা কথা প্রায়ই বলি– সঞ্জীবদার লিরিক ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। ‘আমি তোমাকেই বলে দেব, কি যে একা দীর্ঘ রাত, আমি হেঁটে গেছি বিরান পথে…’ বুকের ভিতর অনেক হাহাকার না থাকলে এই লিরিক লেখা যায়? সঞ্জীবদার আনন্দমুখের পাশে কোথায় একটা নিবিড় বিষাদ ছিল, তা আর জানা হবে না।

আল মাহফুজ: ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র প্রভাব যেমন কলকাতার পরবর্তী ব্যান্ডগুলোর ওপর পড়েছিল, বাংলাদেশে এই প্রসঙ্গে সঞ্জীব চৌধুরীর নাম বললে ভুল বলা হয় কি? আর লেখালেখি জীবনে আপনি ‘গুরু’ মানেন দুজনকে। একজন সঞ্জীব চৌধুরী, আরেকজন কবির সুমন। সঞ্জীব, কবির ছাড়া মহীনের ঘোড়াগুলি কিংবা প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের প্রভাব আপনার লেখালেখিতে আছে?

শেখ রানা: আমার একটু দ্বিমত আছে। সঞ্জীবদার লিরিক বা গানের প্রভাব পরের জেনারেশনে খুব বেশি কি সত্যিই দেখা যায়? আমার মনে হয় না তা। সেটা হবার প্রবল সম্ভাবনা ছিল, যদি ‘দলছুট’ আর সঞ্জীব-বাপ্পা যুগলবন্দী থাকতো। সেটা তো সম্ভব নয়। সঞ্জীবদা আগুনের ফুলকির মতো। এসে চলে গেছেন। কিন্তু সেই ফুলকির আঁচ যারা পেয়েছে, তারাই লালন করবে এই লিরিকের ধারা। মহীনের ঘোড়াগুলির গান যা জেনেছি বা শুনে বিমোহিত হয়েছি, তা তো আদতে মহীনের সম্পাদিত গান। মূল ব্যান্ডকে খুঁজে পেয়েছি অনেক পরে। কিন্ত ততোদিনে যখন ‘যখন ধোঁয়া মেঘে’, ‘ভালোবাসি জোছনায়’ বা ‘সেই ফুলের দল’ কত যে ঝিমঝিম দুপুর দিয়ে গেছে আমাকে।

নাহ, মাহফুজ। লেখায় নেই সেই প্রভাব। প্রতুলের প্রভাবও নেই। কিন্তু প্রতুলের ‘শ্লোগান’, ‘আলু বেচো’, ‘আমার মা গো’, ‘ছোকড়া চাঁদ’, ‘গিয়েছিলাম পাখির হাঁটে’-এই গানগুলো হচ্ছে সঞ্জীবদার মত। ধরা যায় না, শুধু অনুভব করি। খুব পছন্দ আমার প্রতুলের গান।

আল মাহফুজ: বাংলা সংগীতে ‘পরী’ একটা কালজয়ী গান। এই লিরিকটি আপনি লিখেছিলেন নাটোরে বসে। জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ও নাটোরের। নাটোর কি আপনার জন্য পয়া? পরীর অন্তরালের গল্প অনেকবার বলেছেন। এখানে যদি অল্প করে বলতেন।

শেখ রানা: হ্যাঁ, নাটোরের লালপুরে। এই লিরিকটা ছোট্ট একটা মেয়ের জন্য লিখেছিলাম। ওকে ‘লিটিল এঞ্জেল’ বলে ডাকতাম। এক বিকেলে হুট করে ট্রেনে উঠে নাটোরে চলে যাই। আমার এক আপা-ভাই থাকতেন সেখানে। সকালবেলা সেই ছোট্ট মেয়েটা একটা অদ্ভুত সুন্দর নরম আলোয় বসেছিল উদাস হয়ে। ওর দিকে তাকিয়ে আমার প্রথম ভার্সটা লেখা হয়। জয় গোস্বামীর কবিতার বইয়ের সাদা পাতায়। রাতে অন্তরা লিখি। ‘আমি তোমার জন্য এনে দেব রোদেলা সে ক্ষণ, পাখিকে করে দেব তোমার আপনজন…’ এই লাইনগুলো লিখে অপার্থিব ভালো লাগায় মন ভরে গিয়েছিল, মনে আছে।

ততোদিনে বাপ্পা মজুমদারের ‘ধুলো পড়া চিঠি’র গান প্রায় সব হয়ে গেছে। একটা দুটো বাকি ছিল। ক্যাসেট ইনলেতে যতোটুকু লেখা ছিল, কম্পোজ করা হলো। তখনও সুর হয়নি। এক রাতে বাপ্পা মজুমদারের টেলিফোন। আরেক অন্তরা লাগবে। ‘আজ তোমার জোছনা হারায় আলো..’ লেখা হলো। কিছুদিন পর বাপ্পা ভাইয়ের বাসায় যেতেই কানে হেডফোন গুঁজে দিলেন। শুনলাম গানটা। প্রশান্তি লাগলো অন্তরে। একটা সহজিয়া সুন্দর সুর। কিন্তু আমি বা বাপ্পা মজুমদার, কেউ ভাবিনি এই গানটা এতো জনপ্রিয় হবে অথবা প্রকাশের পঁচিশ বছর পরেও নতুন নতুন শ্রোতারা গানটা শুনবে। ‘ধুলো পড়া চিঠি’তে আমার আরেকটা লিরিক ছিল। ‘ভালোবাসা’ শিরোনামে। সেই গানটাও আমার খুব পছন্দের।

আল মাহফুজ: ‘আমি তোমার জন্য এনে দেব রোদেলা সে ক্ষণ, পাখিকে করে দেব তোমার আপনজন, পরী তুমি ভাসবে মেঘের ভাঁজে।’ পুরো গানের মধ্যে এই ভার্সটা লিখে এতো ভালো লেগেছিল কেন?

শেখ রানা: ‘পাখিকে করে দেবো তোমার আপনজন’- এই অভিব্যক্তিটা সুন্দর না? সম্ভবত এই কারণে ভার্সটা আমার এতো পছন্দের।

আল মাহফুজ: কবি বা গীতিকবির কাছে কি শব্দ নাজেল হয়? নাকি অনেক চর্চা, পরিশ্রম করতে হয় একটি মোক্ষম শব্দের জন্য? চিত্রকল্পের গাঁথুনি গড়ার জন্য?

শেখ রানা: কত শব্দ নাজেল হয়। আবার চাইলেও শব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না। একটা ব্যাকুল মুহূর্ত বা খুব নিবিড়ভাবে তুমি কারও দিকে বা কিছুর দিকে তাকিয়ে থেকে শব্দ পেয়ে গেলে। দৃশ্যকল্প তৈরি হতে লাগলো। কবিতা, গীতিকবিতার জন্য সেই টঙ্কারটা লাগে আসলে। কখন কোথায় টঙ্কারটা তোমাকে ছুঁয়ে যাবে, বলা সহজ নয়। কত সহজে ছন্দ মিলে যায়, যেনো অপেক্ষা করে থাকে, মিলেমিশে থাকার জন্য। আবার মাঝেমাঝে কিছুতেই মোক্ষম শব্দ পাওয়া যায় না।

চর্চা, পরিশ্রম, অনেক পড়া– এই ব্যাপারগুলো কবি বা গীতিকবির ইচ্ছেধীন। একেকজন একেকভাবে এই অনুষঙ্গ ধরে বেড়ে ওঠে। ক্রিয়েটিভ রাইটিং নিয়ে আসলে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না। একটা ‘সুররিয়াল গোলকধাম’।

আল মাহফুজ: ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিং’ নিয়ে যখন বললেন, তাহলে জিজ্ঞেস করি– বইমেলায় ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ে আমরা সাধারণত দেখি কবিতা, গল্প বা নভেলের বইয়ের সমাহার। সেই তুলনায় লিরিকের বই খুবই কম দেখা যায়। আগেও আপনার লেখা লিরিকের বই প্রকাশিত হয়েছে। এবারের মেলায়ও আপনার গীতিকবিতার বই ‘মফস্বলের দুপুর’ বের হয়েছে। লিরিকের বই প্রকাশ করতে প্রকাশকের আগ্রহ কেমন থাকে? কেমন সাড়া পান পাঠকের কাছ থেকে?

শেখ রানা: আমি সাড়া পাই। ‘অনুপ্রাণন’-এর প্রকাশক ইউসুফ ভাইয়ের কবিতা-গীতিকবিতার প্রতি অনুরাগ আছে। মফস্বলের দুপুর উনি আগ্রহ নিয়ে প্রকাশ করেছেন। এর আগেও অনুপ্রাণন থেকে ‘কবিতার পোস্টকার্ড’ নামে আমার একটা কবিতার বই বেরিয়েছিল। আর গীতিকবিতার বই বেরিয়েছিল বর্ষাদুপুর-স্টুডেন্ট ওয়েজ থেকে। ‘শব্দ পাখির দল’ নামে। আমার বই প্রকাশের শুরু কিন্তু গীতিকবিতার হাত ধরেই। প্রথম বইটাই ছিল লিরিক ও লিরিকের পেছনের গল্প- ‘আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে’। পাঠকের ভালোবাসা পেয়েছি।

যারা আমার বই পড়েন, তাদের পাঠ প্রতিক্রিয়া পাই আমি। কিন্তু এটা সত্যি, কবিতা বা গীতিকবিতার পাঠক কম। আমি একটু আড়ালে থাকি, পাদপ্রদীপের আলোর বাইরে, সেটাও হয়তো কারণ।

শেখ রানার লেখা সবগুলো বই

আল মাহফুজ: কেন কবিতা বা গীতিকবিতার পাঠক কম? পাঠকের মনে কি কবিতা অনুরণন তুলতে পারছে না? আর কবিতা বা লিরিক লিখে জীবিকা নির্বাহ এদেশের প্রেক্ষাপটে প্রায় অসম্ভব বলা যায়। এখানকার লিরিসিস্টরা কি অ্যাপ্রোপ্রিয়েট রেম্যুনারেশন পায়? রয়্যালটির চুক্তি হয় তাদের সঙ্গে? আপনার ক্ষেত্রে হয়েছে?

শেখ রানা: কবিতা বা গীতিকবিতা অনেকাংশেই তো বিমূর্ত। তার পাঠক কমই থাকবে। আমার এ রকমই মনে হয়। কবি আর কবিতার সাথে প্রচার আর প্রচারণা যায় না আসলে। এতোদূর পথ হেঁটে এসে এটা এখন আমার মনে হয়। অথবা ধরো, আমি এ রকম ভাবি। এই ভাবনাই আমার মনকে শব্দ তালাশে সুখী রাখে।

আমি তো শুধু গীতিকবিতা লিখেই বেঁচে থাকতে চেয়েছিলাম। সেটা সত্যিকার অর্থেই ছেলেমানুষি ছিল। আমাদের অডিও ইন্ডাস্ট্রি কখনোই ইন্ডাস্ট্রি ছিলো না আসলে। ‘ওয়ার্ড অব মাউথ’-এর ওপর ভিত্তি করে কখনও একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে না। এইসব নিয়ে একসময় বহু আক্ষেপের কথা বলেছি। এখন আর ইচ্ছে করে না। আমি একটা লিরিকে যে সম্মানী নেই, তাতে সন্তষ্ট। পাশাপাশি বই থেকেও যদি রয়্যালটি পেতাম নিয়মিত, আমার ভালো লাগতো। রয়্যালটির চুক্তি হয় কারও কারও সাথে। কারও সাথে হয় না। মুখে মুখে হিসেব দেয় বই বিক্রির। আমাদের তো এজেন্ট নেই। লেখক বা গীতিকারের কাজ ক্রিয়েটিভ কাজে মগ্ন থাকা। এইসব অর্থ সংক্রান্ত কাজে মনোনিবেশ করতে পারি না আমি। এটা আমার ব্যর্থতা। অনেকে পারেন। আমি পারি না আসলেই।

আল মাহফুজ: তা ঠিক। কিন্তু ক্রিয়েটিভ কাজে মগ্ন থেকে অনেক কবি বা লেখকের অনিবার্য যাত্রাটা এসে দাঁড়ায় সামগ্রিক থেকে ব্যক্তিক জায়গায়। লেখকের কি সময়কে ধরার দায় আছে? একজন লেখকের কলম বা কীবোর্ডে গণমানুষের কথা উঠে আসা উচিত? যেহেতু প্রতুল, সুমন, সঞ্জীবদের দেখে আপনি লেখালেখিতে এসেছেন, এ ব্যাপারে আপনার পারসেপশন কী?

শেখ রানা: সময়কে ধরে কি সময় অতিক্রম করা যায়? আমি তো একটা ইউটোপিয়ান পৃথিবীতে বাস করেছি বহুদিন। সকল দায়িত্ব এড়িয়ে। আমি দায়িত্ব বিবেচনায় খুবই স্বার্থপর আর অসফল মানুষ। একটা দীর্ঘ সময়, ভালো ও এলোমেলো সময় ধরে, আমি শুধু লেখা নিয়ে ভেবেছি আর থেকেছি। লেখা মানে শুধুই গীতিকবিতা লেখা। আমার কী মনে হয় জানো? ‘লেখকের দায়’ কথাটাই ক্লিশে। লেখককে দায় দিয়ে যেনো নিজের দায় এড়ানো। দায়বদ্ধতা আমাদের সবার আছে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের স্বাধীন সত্তা দিয়েছেন, মানেই আমরা আরও বেশি দায়বদ্ধ।

নিজের লেখা নিয়ে তো উচ্চকিত হয়ে বলতে পারিনি, বলিওনি। কিন্তু তুমি যদি আমার লেখার মনোযোগী পাঠক বা শ্রোতা হও, আমি কিন্তু ‘পোড়া শহর’, ‘শহরতলীর আকাশ’, ‘স্যাটেলাইট’, ‘তাদের কথা হোক’, ‘ভিড় ঠেলে আয়’, ‘সামনে দাঁড়া’ লিখেছি। তার চেয়েও বেশি লিখেছি যেগুলো গান হয়নি, হয়তো হবেও না।

আল মাহফুজ: আমি পড়েছি এবং শুনেছিও। ‘পোড়া শহর’ তো এখনও প্রাসঙ্গিক (সদ্য বেইলি রোডেও পুড়েছে শহর)। অন্য প্রসঙ্গে আসি। গীতিকবির প্রিয় গীতিকবি বা কবি কারা?

শেখ রানা: নজরুল ইসলাম বাবু, কাওসার আহমেদ চৌধুরী। ক্যাসেট বা গান শোনা সময় শুরু থেকেই এই দুই অসামান্য গীতিকবি আমার প্রিয়। ‘এলআরবি’র ভক্ত আমি। ক্যাসেট কিনলে সবার আগে আমি বাপ্পী খানের লিরিক পড়তাম। আমার খুব প্রিয় গীতিকবি। শহীদ মাহমুদ জঙ্গী, লতিফুল ইসলাম শিবলী, নিয়াজ আহমেদ অংশু, যায়েদ আমিন, এঞ্জেল শফিক, সালাউদ্দিন সজল; সবাই আমার প্রিয় গীতিকবি। রাসেল ও নীলের লেখা টানতো আমাকে। তারপর রাজীব আশরাফ। সঞ্জীব চৌধুরী, কবির সুমনের কথা তো জানোই।

কবিতায় মোহগ্রস্ত হয়েছি হেলাল হাফিজের কবিতা পড়ে। নব্বইয়ে হেলাল হাফিজের কবিতার পোস্টকার্ড বের হতো। আমি আগ্রহ করে কিনতাম। দেয়ালে লাগিয়ে রাখতাম সেসব। সৈয়দ শামসুল হক, সোহরাব পাশা, নাজনীন মুন্নির কবিতা ভালো লাগে। জয় গোস্বামীর কবিতা আমার খুব প্রিয় ছিল, এখনও আছে। গীতিকবির তালিকায় লিওনার্ড কোহেন, অঞ্জন দত্তও আছে। লম্বা লিস্ট আসলে। অনেক প্রিয় নামই হয়তো পরে মনে পড়বে।

আল মাহফুজ: আচ্ছা। শেষ প্রশ্ন– একজন কবি বা লেখকের কি শিরদাঁড়া সোজা রাখা জরুরি? নাকি আপোষ করে চলার মন্ত্রও জপতে হয় কখনও কখনও?

শেখ রানা: একজন কবি বা লেখকের মগ্ন থাকা জরুরি। মনের দিকে ঝুঁকে মনের সাথে কথা বলা জরুরি। দ্বন্দ্ব আর দ্বন্দমুখরতার থেকে বের হয়ে মন শান্ত রাখা জরুরি। বাকি সব হলো নতজানু সমাজের শেখানো বর্ণমালা। সেখানে বাকি সবার মতো মন্ত্রপাঠ করতে হয় জীবন যাপনের। সেই যাপনে কেউ কেউ সামনে দাঁড়ায়, আবার সময়ে হেরে যাওয়ার মন্ত্রও পাঠ করে।

আল মাহফুজ: গীতিকবিতা আর শব্দ তালাশে আপনার অভিযাত্রা সার্থক হোক, একজন গীতিকবি হয়েই আজীবন আপনার যাত্রা চলতে থাকুক, এই শুভকামনা। যমুনা অনলাইনকে সময় দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

শেখ রানা: তোমাকেও ধন্যবাদ, মাহফুজ। যমুনা টিভি অনলাইনের সবাইকে আমার শুভেচ্ছা জানিও।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply